অতিবন্যা-জলাবদ্ধতা এবং জনদুর্ভোগের জন্য দায়ী বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ, দালাল শাসকশ্রেণি ও সরকার

আন্দোলন প্রতিবেদন
শনিবার, ২২ আগস্ট ২০২০ | অনলাইন সংস্করণ
প্রায় প্রতি বছরই বন্যা হচ্ছে। মানুষ বিশেষত গ্রামীণ জনগণ অবর্ণনীয় ভোগান্তিতে পড়ছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রায় দেড় মাস ধরে বন্যা চলছে। সারাদেশে লক্ষ লক্ষ কৃষকের ঘড়বাড়ি, ফসলি জমি, বীজ তলা তলিয়ে গেছে। কোটি কোটি টাকার ফসল, অবকাঠামো নষ্ট হয়েছে, গবাদি-পশু, মাছের খামারসহ গ্রামীণ জনগণের ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কেবলমাত্র মাছেরই ক্ষতি হয়েছে ৩৮২ কোটি টাকার (সূত্র প্রথম আলো ১৪ আগস্ট’২০)। বেসরকারী সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর এক প্রতিবেদন থেকে জানানা যায় এ পর্যন্ত ৪ কোটি ২০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ শস্যের ক্ষতি হয়েছে। ৭ কোটি ৪০ লাখ ৫০ হাজার ডলার মূল্যের সমপরিমাণ গবাদিপশুর ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় ১ লাখ ২৫ হাজার ৫৪৯ হেক্টর কৃষিজমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। (প্রথম আলো ২০ আগস্ট’২০)। শত শত জনগণ নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে ভিটে-বাড়ি, ফসলি জমি হারিয়ে নিঃশ্ব হচ্ছেন। সরকারের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোও পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে বন্যাকবলিত জনগণ ঘরবাড়ী ছেড়ে বেড়িবাঁধে বা উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। অর্ধহারে-অনহারে এবং বিশুদ্ধ পানির অভাবে দিন কাটিয়েছে ও কাটাচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ গত ৩০ জুন থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ২০০ মানুষ পানিতে ডুবে এবং সাপের কামড়ে এবং বিভিন্ন পানি বাহিত রোগে মারা গেছেন। রোগাক্রান্ত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ।
উত্তরে বন্যার পানি কমেছে, জনগণ তাদের ঘরবাড়িতে ফিরে গেলেও তাদের দুর্দষা সহসাই লাঘব হবে না। মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে বন্যা চলছে। তাদের পরিণতিও হবে একই। দরিদ্র কৃষকের কাজ নেই, খাবে কি? ফসল যা নষ্ট হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ কিভাবে হবে, তার কোন দিসা নেই। নতুন করে আবাদ কীভাবে করবে, নদীভাঙ্গা নিঃস্ব মানুষ তারা কিভাবে চলবে, কৃষকের সেই দুর্ভাবনার শেষ নেই। প্রতিদিন বন্যাদূর্গত মানুষের আহাজারী শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সরকারের গলাবাজীর কমতি নেই।
প্রতি বছরই ঘূর্ণিঝড়, বন্যায় দরিদ্র কৃষক, শ্রমজীবীসহ সাধারণ জনগণ চরম দুর্ভোগের শিকার হন। শাসকশ্রেণি এবং তাদের সরকার এগুলোকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে এড়িয়ে গিয়ে মানুষকে বোকা বানাতে চাইছে। এবারের করোনা ভাইরাস প্রাকৃতিক বিষয় হলেও এই মহামারীর জন্য দায়ি কে? সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব সংস্থার মহারথীরাই বলছে এ সবের জন্য সাম্রাজ্যবাদী মুনাফাখোরী উৎপাদন ব্যবস্থা এবং বন-জঙ্গল কেটে লুটপাট, পরিবেশ ধ্বংস করার ফলে জলবায়ুর পরিবর্তনই মূলত দায়ী। এবারের করোনাকালে এই প্রশ্নের আলোচনা আরো জোড়েশোড়ে উঠে এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তনরোধে সাম্রাজ্যবাদীরা প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা খরচ করে সভা-সমাবেশ করে। বিভিন্ন প্রতিশ্রতি দেয়া পর্যন্তই সার। কাজের কাজ কিছুই করছে না।
কথা বলছি বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে। বিভিন্ন বিষেশজ্ঞগণ বন্যা এবং জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে যা বলেন তা হলো অপরিকল্পিত বাঁধ, ব্যারাজ, জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, রাস্তা-ঘাট, রেল লাইন তৈরি, খাল-বিল ভরাট করে বাড়ী, মাকের্টসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ, পলিমাটিতে ভরাট হওয়া নদী-খাল খনন না করা ইত্যাদি। এমকি এবারের বন্যায় কুড়িগ্রামের উলিপুর-চিলমারীর জনগণের অভিযোগ হচ্ছে বিলগুলোর পানি আসা-যাওয়ার কালভার্টগুলোর মুখ বন্ধ করে ঘরবাড়ি ও মার্কেট এবং বাসস্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। এখানে তিস্তা এবং ব্রহ্মপুত্র নদী তীরে যে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে সেখানে আরো কয়েকটি নদী এসে মিলেছে। কিন্তু আধা সচল একটি মাত্র ইসগেট। ফলে সব পানি এখানে এসে আটকে গেছে, বাঁধ ভাঙ্গার উপক্রম হলে এলাকাবাসীরা বাঁধ কেটে দেওয়ার দাবি তুলেছিলেন। ঢাকার কেরানীগঞ্জের কয়েকটি গ্রামের জনগণের অভিযোগ ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীরা ধলেশ্বরী, কালিগঙ্গা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় নদী ভাঙ্গনে এলাকার তিন শতাধিক ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। সারাদেশের অপরিকল্পিত, অবৈধ অবকাঠামো নির্মাণ করে বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহতা বৃদ্ধি করেছে শাসকশ্রেণিও আওয়ামী সরকার।
বাংলাদেশের বন্যার ধরন ও পরিবর্তন নিয়ে স্কটল্যান্ডের ডান্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক নন্দন মুখার্জি বলেছেন, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা অববাহিকায় প্রায় ৫০০টি বাঁধ, ব্যারাজ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। সেগুলোর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে। আর এসব অবকাঠামো চীন, ভারত ও নেপালে। সেসব দেশে বন্যা ১০ দিনের বেশি স্থায়ী না হলেও বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। ১৯২২ সালে বন্যা নিয়ে ম্যানচেষ্টার গার্ডিয়ান পত্রিকার এক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল বন্যার জন্য দায়ী নদী নয়, অতিবৃষ্টি নয়, দায়ী ব্রিটিশের তৈরি রেলপথ। তা হলে দেখা যাচ্ছে বন্যার জন্য দায়ী প্রকৃতি নয়। দায়ী হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ এবং দালার শাসকশ্রেণি এবং তাদের ব্যবস্থা। চীন-ভারত-নেপালে বিশেষত ভারতের শাসকশ্রেণি শুকনা মৌসমে নদ-নদীর পানি আটকে রেখে বাংলাদেশকে পানিশূণ্য করে মারে এবং বর্ষা মৌসুমে ইসগেট খুলে দিয়ে বন্যা সৃষ্টি করে। এবং দেশের ভেতরে শাসকশ্রেণি ও সরকারের গণবিরোধী ব্যবস্থাপনায় জনগণকে যে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে এবং হচ্ছে তা উপরেই উল্লেখ করা হয়েছে।
ভারতের উজানে অতি বৃষ্টি থেকে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢল আসায় ব্রহ্মপুত্র, যমুনাসহ বেশ কিছু নদ-নদীতে পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। কিন্তু জনগণের এই চরম দূর্ভোগের মধ্যে বর্তমান ফ্যাসিবাদী সরকার তেমন কোন কার্যকরি উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বন্যার্ত মানুষের কাছে ঠিকমত এবং পর্যপ্ত ত্রাণও পৌঁছানো হয়নি। এই দূর্যোগের সময়েও আওয়ামী লুটপাট অব্যাহতভাবে চলছে। করোনা মোকাবেলায় ব্যর্থ আওয়ামী সরকার করোনার মতই বন্যা মোকাবেলার কোন প্রস্তুতিই নেয়নি। অথচ দূর্যোগমন্ত্রী নির্লজ্জের মত বলছে এটা স্বাভাবিক বন্যা এবং আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে!
কিন্তু বন্যা নিয়ন্ত্রনের জন্য বাঁধ নির্মাণে দূর্নীতির খবর প্রতিবছর বন্যা এলেই শোনা যায় এবং মন্ত্রী আমলারা ফিবছর একই প্রতিশ্রতি দিলেও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ যথাসময়ে মেরামত ও নির্মাণ করা হয়না। এমন সময়ে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করা হয় যখন বন্যা এসে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ যথাসময়ে না করার বড় কারণ হলো বছর বছর বাঁধ ভাঙ্গলে বছর বছর লুটপাট করা যায়।এতে কামলা খাটা, পা ফাটা কৃষকের কোন লাভ না হলেও আওয়ামী লুটপাটকারীদের পকেট ঠিকই ভারী হয়। অন্যদিকে অসহায় দরিদ্র জনগণ সহায় সম্বল হারিয়ে পথে বসেন। এইভাবেই যুগের পর যুগ ধরে চলছে।
সম্প্রসারণবাদী ভারতরাষ্ট্র তিস্তাসহ প্রায় ৫৪টি অভিন্ন নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে ’৭১ সালের পর থেকেই নানান তালবাহানায় বাংলাদেশের জনগণকে বঞ্চিত করে রেখেছে। এসব নদীতে একের পর এক অবৈধ বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে একদিকে শুকিয়ে মারছে অন্যদিকে অতি বৃষ্টির সময়ে বাঁধ খুলে দিয়ে অসময়ে বন্যায় বাংলাদেশকে ভাসিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিটি সরকার ভারতের তাবেদারীর মাধ্যমে এদেশের মানুষকে নদীর পানি থেকে বঞ্চিত করেছে। বর্তমান আওয়ামী মহাজোট সরকার বার বার ভারতের সাথে দেশ বিরোধী চুক্তি করলেও তিস্তার পানি সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে।
দেশে মধ্যেও শাসকশ্রেণির বিভিন্ন সরকার এবং বর্তমান হাসিনা সরকার বন্যা নিয়ন্ত্রণের কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। অপরিকল্পিত রাস্তা-ঘাট তৈরি, খালবিল ভরাট করে বাড়ি, মার্কেট, বাঁধ নির্মাণ রোধ করার কোন উদ্যোগ নেয়নি, বা নির্মিত অবকাঠামো ভেঙ্গে দেবার ব্যবস্থা করেনি। বরং অবাধে তা চলতে দিচ্ছে। পলি মাটি দ্বারা নদী-খাল ভরাট হলে তা খনন না করা এবং বন্যা সাথে বসবাস উপযোগী ঘরবাড়ী নির্মাণেরও কোন পদক্ষেপ না নেয়ার কারণেই প্রতি বছর শ্রমিক-কৃষক ও দরিদ্র জনগণকে বন্যা জনিত চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তারা অর্থনৈতিক ব্যাপক ক্ষতির সম্মুক্ষীন হচ্ছেন। তারা কৃষক এবং কৃষিকে বন্যা থেকে রক্ষার করার কোন কার্যকরী ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তারা ব্যস্ত আছে উন্নয়নের নামে সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ এবং দালাল শাসকশ্রেণির স্বার্থরক্ষার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে। তারা সর্বস্তরের জনগণের প্রতিবাদ সত্তে ও উন্নয়নের নামে সুন্দরবন সহ দেশের পরিবেশ ধ্বংস করে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে। ফলে অতি বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস হয়ে লক্ষ লক্ষ জনগণের জীবন কেড়ে নিচ্ছে এবং বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। তাই এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য দায়ী হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ-ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ এবং দেশের দালাল শাসকশ্রেণি ও তাদের ব্যবস্থা।
চলমান ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার হচ্ছে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতের একনিষ্ঠ দালাল। এজন্যই তারা বন্যা সমস্যার সামগ্রিক সমাধান করতে সক্ষম নয়। তাই চলমান বন্যা সহ সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় পরিবেশ ধ্বংসকারী আওয়ামী সরকারের সকল গণবিরোধী কর্মসূচি বন্ধ করতে বাধ্য করতে হবে। সেজন্য জনগণের শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। একই সাথে বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদের দালাল শাসকশ্রেণি এবং ভারতের দালাল আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারকে উচ্ছেদ করতে হবে। এই রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তন তথা সমাজতন্ত্র-কমিউনিজমের লক্ষ্যে নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করতে হবে। এমন হলেই কেবলমাত্র বন্যা সহ সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগ স্থায়ীভাবে মোকাবেলায় গণমুখী প্রকল্প নেয়া ও বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। শ্রমিকশ্রেণির আদর্শ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদে সজ্জিত কোন সংগঠনের নেতৃত্বেই এমন বিপ্লব সংগ্রাম এগিয়ে যেতে পারে।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
অতিবন্যা-জলাবদ্ধতা এবং জনদুর্ভোগের জন্য দায়ী বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ, দালাল শাসকশ্রেণি ও সরকার
প্রায় প্রতি বছরই বন্যা হচ্ছে। মানুষ বিশেষত গ্রামীণ জনগণ অবর্ণনীয় ভোগান্তিতে পড়ছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রায় দেড় মাস ধরে বন্যা চলছে। সারাদেশে লক্ষ লক্ষ কৃষকের ঘড়বাড়ি, ফসলি জমি, বীজ তলা তলিয়ে গেছে। কোটি কোটি টাকার ফসল, অবকাঠামো নষ্ট হয়েছে, গবাদি-পশু, মাছের খামারসহ গ্রামীণ জনগণের ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কেবলমাত্র মাছেরই ক্ষতি হয়েছে ৩৮২ কোটি টাকার (সূত্র প্রথম আলো ১৪ আগস্ট’২০)। বেসরকারী সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর এক প্রতিবেদন থেকে জানানা যায় এ পর্যন্ত ৪ কোটি ২০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ শস্যের ক্ষতি হয়েছে। ৭ কোটি ৪০ লাখ ৫০ হাজার ডলার মূল্যের সমপরিমাণ গবাদিপশুর ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় ১ লাখ ২৫ হাজার ৫৪৯ হেক্টর কৃষিজমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। (প্রথম আলো ২০ আগস্ট’২০)। শত শত জনগণ নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে ভিটে-বাড়ি, ফসলি জমি হারিয়ে নিঃশ্ব হচ্ছেন। সরকারের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোও পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে বন্যাকবলিত জনগণ ঘরবাড়ী ছেড়ে বেড়িবাঁধে বা উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। অর্ধহারে-অনহারে এবং বিশুদ্ধ পানির অভাবে দিন কাটিয়েছে ও কাটাচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ গত ৩০ জুন থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ২০০ মানুষ পানিতে ডুবে এবং সাপের কামড়ে এবং বিভিন্ন পানি বাহিত রোগে মারা গেছেন। রোগাক্রান্ত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ।
উত্তরে বন্যার পানি কমেছে, জনগণ তাদের ঘরবাড়িতে ফিরে গেলেও তাদের দুর্দষা সহসাই লাঘব হবে না। মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে বন্যা চলছে। তাদের পরিণতিও হবে একই। দরিদ্র কৃষকের কাজ নেই, খাবে কি? ফসল যা নষ্ট হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ কিভাবে হবে, তার কোন দিসা নেই। নতুন করে আবাদ কীভাবে করবে, নদীভাঙ্গা নিঃস্ব মানুষ তারা কিভাবে চলবে, কৃষকের সেই দুর্ভাবনার শেষ নেই। প্রতিদিন বন্যাদূর্গত মানুষের আহাজারী শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সরকারের গলাবাজীর কমতি নেই।
প্রতি বছরই ঘূর্ণিঝড়, বন্যায় দরিদ্র কৃষক, শ্রমজীবীসহ সাধারণ জনগণ চরম দুর্ভোগের শিকার হন। শাসকশ্রেণি এবং তাদের সরকার এগুলোকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে এড়িয়ে গিয়ে মানুষকে বোকা বানাতে চাইছে। এবারের করোনা ভাইরাস প্রাকৃতিক বিষয় হলেও এই মহামারীর জন্য দায়ি কে? সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব সংস্থার মহারথীরাই বলছে এ সবের জন্য সাম্রাজ্যবাদী মুনাফাখোরী উৎপাদন ব্যবস্থা এবং বন-জঙ্গল কেটে লুটপাট, পরিবেশ ধ্বংস করার ফলে জলবায়ুর পরিবর্তনই মূলত দায়ী। এবারের করোনাকালে এই প্রশ্নের আলোচনা আরো জোড়েশোড়ে উঠে এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তনরোধে সাম্রাজ্যবাদীরা প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা খরচ করে সভা-সমাবেশ করে। বিভিন্ন প্রতিশ্রতি দেয়া পর্যন্তই সার। কাজের কাজ কিছুই করছে না।
কথা বলছি বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে। বিভিন্ন বিষেশজ্ঞগণ বন্যা এবং জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে যা বলেন তা হলো অপরিকল্পিত বাঁধ, ব্যারাজ, জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, রাস্তা-ঘাট, রেল লাইন তৈরি, খাল-বিল ভরাট করে বাড়ী, মাকের্টসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ, পলিমাটিতে ভরাট হওয়া নদী-খাল খনন না করা ইত্যাদি। এমকি এবারের বন্যায় কুড়িগ্রামের উলিপুর-চিলমারীর জনগণের অভিযোগ হচ্ছে বিলগুলোর পানি আসা-যাওয়ার কালভার্টগুলোর মুখ বন্ধ করে ঘরবাড়ি ও মার্কেট এবং বাসস্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। এখানে তিস্তা এবং ব্রহ্মপুত্র নদী তীরে যে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে সেখানে আরো কয়েকটি নদী এসে মিলেছে। কিন্তু আধা সচল একটি মাত্র ইসগেট। ফলে সব পানি এখানে এসে আটকে গেছে, বাঁধ ভাঙ্গার উপক্রম হলে এলাকাবাসীরা বাঁধ কেটে দেওয়ার দাবি তুলেছিলেন। ঢাকার কেরানীগঞ্জের কয়েকটি গ্রামের জনগণের অভিযোগ ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীরা ধলেশ্বরী, কালিগঙ্গা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় নদী ভাঙ্গনে এলাকার তিন শতাধিক ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। সারাদেশের অপরিকল্পিত, অবৈধ অবকাঠামো নির্মাণ করে বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহতা বৃদ্ধি করেছে শাসকশ্রেণিও আওয়ামী সরকার।
বাংলাদেশের বন্যার ধরন ও পরিবর্তন নিয়ে স্কটল্যান্ডের ডান্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক নন্দন মুখার্জি বলেছেন, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা অববাহিকায় প্রায় ৫০০টি বাঁধ, ব্যারাজ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। সেগুলোর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে। আর এসব অবকাঠামো চীন, ভারত ও নেপালে। সেসব দেশে বন্যা ১০ দিনের বেশি স্থায়ী না হলেও বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। ১৯২২ সালে বন্যা নিয়ে ম্যানচেষ্টার গার্ডিয়ান পত্রিকার এক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল বন্যার জন্য দায়ী নদী নয়, অতিবৃষ্টি নয়, দায়ী ব্রিটিশের তৈরি রেলপথ। তা হলে দেখা যাচ্ছে বন্যার জন্য দায়ী প্রকৃতি নয়। দায়ী হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ এবং দালার শাসকশ্রেণি এবং তাদের ব্যবস্থা। চীন-ভারত-নেপালে বিশেষত ভারতের শাসকশ্রেণি শুকনা মৌসমে নদ-নদীর পানি আটকে রেখে বাংলাদেশকে পানিশূণ্য করে মারে এবং বর্ষা মৌসুমে ইসগেট খুলে দিয়ে বন্যা সৃষ্টি করে। এবং দেশের ভেতরে শাসকশ্রেণি ও সরকারের গণবিরোধী ব্যবস্থাপনায় জনগণকে যে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে এবং হচ্ছে তা উপরেই উল্লেখ করা হয়েছে।
ভারতের উজানে অতি বৃষ্টি থেকে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢল আসায় ব্রহ্মপুত্র, যমুনাসহ বেশ কিছু নদ-নদীতে পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। কিন্তু জনগণের এই চরম দূর্ভোগের মধ্যে বর্তমান ফ্যাসিবাদী সরকার তেমন কোন কার্যকরি উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বন্যার্ত মানুষের কাছে ঠিকমত এবং পর্যপ্ত ত্রাণও পৌঁছানো হয়নি। এই দূর্যোগের সময়েও আওয়ামী লুটপাট অব্যাহতভাবে চলছে। করোনা মোকাবেলায় ব্যর্থ আওয়ামী সরকার করোনার মতই বন্যা মোকাবেলার কোন প্রস্তুতিই নেয়নি। অথচ দূর্যোগমন্ত্রী নির্লজ্জের মত বলছে এটা স্বাভাবিক বন্যা এবং আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে!
কিন্তু বন্যা নিয়ন্ত্রনের জন্য বাঁধ নির্মাণে দূর্নীতির খবর প্রতিবছর বন্যা এলেই শোনা যায় এবং মন্ত্রী আমলারা ফিবছর একই প্রতিশ্রতি দিলেও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ যথাসময়ে মেরামত ও নির্মাণ করা হয়না। এমন সময়ে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করা হয় যখন বন্যা এসে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ যথাসময়ে না করার বড় কারণ হলো বছর বছর বাঁধ ভাঙ্গলে বছর বছর লুটপাট করা যায়।এতে কামলা খাটা, পা ফাটা কৃষকের কোন লাভ না হলেও আওয়ামী লুটপাটকারীদের পকেট ঠিকই ভারী হয়। অন্যদিকে অসহায় দরিদ্র জনগণ সহায় সম্বল হারিয়ে পথে বসেন। এইভাবেই যুগের পর যুগ ধরে চলছে।
সম্প্রসারণবাদী ভারতরাষ্ট্র তিস্তাসহ প্রায় ৫৪টি অভিন্ন নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে ’৭১ সালের পর থেকেই নানান তালবাহানায় বাংলাদেশের জনগণকে বঞ্চিত করে রেখেছে। এসব নদীতে একের পর এক অবৈধ বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে একদিকে শুকিয়ে মারছে অন্যদিকে অতি বৃষ্টির সময়ে বাঁধ খুলে দিয়ে অসময়ে বন্যায় বাংলাদেশকে ভাসিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিটি সরকার ভারতের তাবেদারীর মাধ্যমে এদেশের মানুষকে নদীর পানি থেকে বঞ্চিত করেছে। বর্তমান আওয়ামী মহাজোট সরকার বার বার ভারতের সাথে দেশ বিরোধী চুক্তি করলেও তিস্তার পানি সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে।
দেশে মধ্যেও শাসকশ্রেণির বিভিন্ন সরকার এবং বর্তমান হাসিনা সরকার বন্যা নিয়ন্ত্রণের কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। অপরিকল্পিত রাস্তা-ঘাট তৈরি, খালবিল ভরাট করে বাড়ি, মার্কেট, বাঁধ নির্মাণ রোধ করার কোন উদ্যোগ নেয়নি, বা নির্মিত অবকাঠামো ভেঙ্গে দেবার ব্যবস্থা করেনি। বরং অবাধে তা চলতে দিচ্ছে। পলি মাটি দ্বারা নদী-খাল ভরাট হলে তা খনন না করা এবং বন্যা সাথে বসবাস উপযোগী ঘরবাড়ী নির্মাণেরও কোন পদক্ষেপ না নেয়ার কারণেই প্রতি বছর শ্রমিক-কৃষক ও দরিদ্র জনগণকে বন্যা জনিত চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তারা অর্থনৈতিক ব্যাপক ক্ষতির সম্মুক্ষীন হচ্ছেন। তারা কৃষক এবং কৃষিকে বন্যা থেকে রক্ষার করার কোন কার্যকরী ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তারা ব্যস্ত আছে উন্নয়নের নামে সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ এবং দালাল শাসকশ্রেণির স্বার্থরক্ষার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে। তারা সর্বস্তরের জনগণের প্রতিবাদ সত্তে ও উন্নয়নের নামে সুন্দরবন সহ দেশের পরিবেশ ধ্বংস করে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে। ফলে অতি বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস হয়ে লক্ষ লক্ষ জনগণের জীবন কেড়ে নিচ্ছে এবং বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। তাই এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য দায়ী হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ-ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ এবং দেশের দালাল শাসকশ্রেণি ও তাদের ব্যবস্থা।
চলমান ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার হচ্ছে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতের একনিষ্ঠ দালাল। এজন্যই তারা বন্যা সমস্যার সামগ্রিক সমাধান করতে সক্ষম নয়। তাই চলমান বন্যা সহ সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় পরিবেশ ধ্বংসকারী আওয়ামী সরকারের সকল গণবিরোধী কর্মসূচি বন্ধ করতে বাধ্য করতে হবে। সেজন্য জনগণের শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। একই সাথে বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদের দালাল শাসকশ্রেণি এবং ভারতের দালাল আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারকে উচ্ছেদ করতে হবে। এই রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তন তথা সমাজতন্ত্র-কমিউনিজমের লক্ষ্যে নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করতে হবে। এমন হলেই কেবলমাত্র বন্যা সহ সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগ স্থায়ীভাবে মোকাবেলায় গণমুখী প্রকল্প নেয়া ও বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। শ্রমিকশ্রেণির আদর্শ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদে সজ্জিত কোন সংগঠনের নেতৃত্বেই এমন বিপ্লব সংগ্রাম এগিয়ে যেতে পারে।
আরও খবর
- শনি
- রোব
- সোম
- মঙ্গল
- বুধ
- বৃহ
- শুক্র